দুঃসময়ের ধারাভাষ্য; ৩১অক্টোবর – ১১ নভেম্বর ২০১৫

প্রাককথন:

আজ থেকে এক দশক আগের কথা। 

৩১ অক্টোবর ২০১৫, শনিবার। হেমন্তের নরম রোদে ঢেকে থাকা ঢাকা৷ এর আগে সবশেষ অফিসে গিয়েছিলাম ২৫ অক্টোবর তারিখে, সেদিন একটা মিটিং ছিল। মিটিংয়ের অতিথি চলে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর আমি অফিস থেকে বের হই যখন সন্ধ্যা সমাগত তখন। কল্পনাও করি নি সেই সন্ধ্যাটাই হবে প্রিয় স্বদেশে, শুদ্ধস্বর অফিসে আমার শেষ সুস্থ-স্বাভাবিক সন্ধ্যা!

এর পর অন্তিম অক্টোবরের আগে আর অফিসে যাওয়া হয়নি, মানে যাওয়াটা এড়িয়ে গেছি। সেই সময়টা ছিল এমন যে, প্রতিটি মুহূর্তে তখন টের পাচ্ছিলাম কেউ না কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। অজ্ঞাত একদল ঘাতক যেন নিশ্বাস ফেলছে আমার ঘাড়ে এসে। বাসা-অফিস-রাস্তা সবখানেই একটা চাপা আতঙ্ক নিয়ে দিনগুলো, মুহূর্তগুলো কাটছিল আমার। হেমন্তের মন্থর-হালকা হিমের সময় স্বস্তির বদলে আমাকে অজানা উৎকণ্ঠায় আকুল করে রেখেছিল।

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫-তে আমাদের বন্ধু মুক্তচিন্তার লেখক অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে হত্যা করার দিন কয়েক পর একদিন বিকেলে একজন আগন্তুক লালমাটিয়ার শুদ্ধস্বর অফিসে এসে আমার সাথে দেখা করতে চায়। অফিস সহকারী সেই ব্যক্তির একটি ভিজিটিং কার্ড আমাকে দিয়ে বলে, কার্ডদাতা লোকটি দেখা করতে চায়। অভিজিৎ-হত্যার ভয়াবহ রাতেই আমি আমার জীবননাশী অনেকগুলো হুমকির তথ্য পেতে থাকি । তার দু-দিন পর আমার বন্ধু লেখক-সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফি ও ব্যবসায়ী মনসুর ভাইয়ের সহযোগিতায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়রি দায়ের করি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তখন বেশ আন্তরিকতার সাথে আমাকে ও আমার প্রকাশনা সংস্থা ‘শুদ্ধস্বর’ অফিসের নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদান করেন। ডায়রি করার একদিন পর বিকেলে দশ-পনেরো জন পুলিশসদস্য আমাদের অফিস পরিদর্শন করতে আসেন এবং প্রতিটি ঘর তল্লাশি করেন। তারা এমনভাবে তল্লাশি করছিল যে, যেন লুকিয়ে রাখা কোনো কিছু খুঁজছেন। তল্লাশি শেষ করে চলে যাওয়ার আগে পুলিশ দলের নেতা আমার কাছে চা-নাশতার টাকা দাবি করেন। আমি একটু বিব্রতবোধ করেও অগত্যা আড়াই হাজার টাকা তার হাতে তুলে দেই। তিনি অসন্তুষ্ট ভাবে টাকাগুলো গ্রহণ করতে করতে বলেন, এই সামান্য টাকা দিয়ে এতগুলো মানুষ কীভাবে ম্যানেজ করবেন!

সে যাই হোক৷ যে কথা বলছিলাম। ভিজিটিং কার্ড পাঠানো তরুণের সাথে দেখা করার আগে আমি তখন মনসুর ভাইকে ফোন করে অফিসে আসতে অনুরোধ করি। মনসুরভাই খুব দ্রুতই চলে আসেন। মনসুরভাইয়ের উপস্থিতিতে আমি তরুণকে ডেকে পাঠাই। সে বলে সে শুদ্ধস্বরে চাকরি করতে চায়। তার সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সে অন্য একজনের ভিজিটিং কার্ড ব্যবহার করে, মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। পুরো ঘটনাটি খুব রহস্যময় মনে হয় আমার কাছে। বিষয়টি স্থানীয় পুলিশকেও জানানো হয়েছিল। জানিনা, হয়তো অক্টোবরের হামলার প্রাথমিক রেকি করতেই এসেছিল সেই ‘চাকরি-খোঁজা’ রহস্যময় তরুণ!

তো ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নানান রহস্যময় ঘটনা, ফোন কল, ফেসবুক মেসেজ এবং প্রতিনিয়ত কেউ অনুসরণ করছে এমন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে আমার সময়গুলো অতিক্রান্ত হচ্ছিল। ঐ হাড়-হিম করা সময়ের কথা মনে হলে এখনো ভয় ও আতঙ্কে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। এ এমন এক অভিজ্ঞতা, যা অন্যকে বলে বুঝানোর মতো নয়। সে সময় যেন নিশ্চিতভাবেই এক অনিশ্চিত আগামীর আঁচ পাচ্ছিলাম আমি।

বলছিলাম ৩১ অক্টোবর ২০১৫ এর কথা। রক্তাক্ত স্মৃতি যতই ভুলে যেতে চাই, দশ বছর আগের ঘটনাগুলো এখনও মনে পড়ে, মন বারবার ফিরে যায় রক্তে রক্তে লাল হয়ে যাওয়া সেই সময়টাতে।  ৩০ অক্টোবর রাতেই ভেবে রেখেছিলাম পরদিন অফিসে যাবো। অনেক জরুরি কাজ জমে আছে। প্রয়াত বন্ধু  অভিজিৎ রায়ের বইগুলোর তখন বেশ চাহিদা। কিন্তু ডিবি থেকে বলা হয়েছে বইগুলো যেন আর না ছাপি এবং বিক্রি না করি। এখানে উল্লেখ্য যে, ডিবির সে সতর্কবার্তার বছরখানেক আগে থেকেই অনলাইন বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ‘রকমারি’ অভিজিৎ রায়ের সমুদয় বই বিক্রয় বন্ধের ঘোষণা দেয়। এর প্রতিবাদে ‘শুদ্ধস্বর’ রকমারির সাথে সব ধরনের বই-বিক্রয় কার্যক্রম এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিল। বলাই বাহুল্য, চিন্তার মুক্তি এবং প্রকাশনার স্বাধীনতা নিয়ে আমার ও শুদ্ধস্বরের লড়াইটা আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। ২০১৫-এর অন্তিম অক্টোবরে যা রক্তাক্ত পরিণতি পেল।

৩১ অক্টোবর, ২০১৫। আমার  জীবন এবং বাংলাদেশের প্রকাশনার ইতিহাসেও যে একটা দুঃসহ দাগ পড়তে যাচ্ছে সেদিন, তা দিনের শুরুতে চিন্তাও করিনি। যদিও অজানা আশঙ্কায় বুক দুরুদুরু করত সে সময়ের পরিধিজুড়ে। সকালে নাশতা খেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। শনিবার, স্কুল সাপ্তাহিক বন্ধ বলে আমাদের দুই কন্যা তখনো ঘুমে। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আমার স্ত্রী রুনা একটা লিস্ট দিয়ে বললো, ‘আজ হ্যালোইন, মেয়েরা রাতে মজা করার জন্য এই এই জিনিসগুলো চেয়েছে। আসার সময় নিয়ে এসো।‘ আমি লিস্ট পকেটে ঢুকিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। তখন জানতাম না, এই বাসায় আর কোনোদিন ফেরা হবে না আমার!

হাসপাতালের জরুরী বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে টুটুল

লালমাটিয়ার যে ভবনের চতুর্থ তলায় শুদ্ধস্বরের অফিস ছিলো, সে ভবনে কয়েকটি আবাসিক ফ্ল্যাট এবং কয়েকটি বাণিজ্যিক কার্যালয় ছিল। তাছাড়া দ্বিতীয় এবং পঞ্চম তলায় দুটি কোচিং সেন্টার থাকায় ভবনটায় সবসময় লোকজনের আনাগোনা থাকতো।  আমি অফিসে যখন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছিলাম, তখন আমার পেছন পেছন এক তরুণকে উঠতে দেখলাম। আমি চারতলায় উঠে যখন কলিং বেল বাজাচ্ছিলাম, তখন দেখলাম ছেলেটা খুবই শ্লথ গতিতে আমাকে অতিক্রম করে উপরে যাওয়ার সিঁড়িতে পা রাখছে। আমার অফিসের দরজা খোলার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ছেলেটির গতিবিধি আমার কাছে একটু অস্বস্তিকর ঠেকেছিলো। ছেলেটির পিঠে একটি ব্যাকপ্যাক ছিল।

যাই হোক, শুদ্ধস্বরের অফিস সহকারী দরজা খুলে দিলে আমি অফিসে ঢুকে যাই। ছেলেটিকে আর খেয়াল করা হয়নি। ঘণ্টাখানেক পর লেখকবন্ধু রণদা (রণদীপম বসু)  ফোন করে বললেন, তিনি আসছেন। রণদা আসার পর অনুজ বন্ধু কবি ও বুয়েটছাত্র তারেক রহিমকে ফোন করেন। তারেক রণদাকে জানায় সেও আসছে শুদ্ধস্বরে। আমি এর মধ্যে অফিস সহকারীকে দিয়ে কিছু স্ন্যাকস আনিয়ে নিলাম। চা বানানোর ব্যবস্থা আমাদের অফিসেই ছিলো। তারেক চলে এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমাদের গল্প-আড্ডা- কাজের কথাবার্তা এবং চা-স্ন্যাকস পর্ব চলতে লাগল। এখানে বলে রাখা ভাল যে, শুদ্ধস্বর অফিসে সবসময়ই ক্যাজুয়াল আড্ডা চলতে থাকতো। বন্ধু-বান্ধব পরিচিতজনরা হুটহাট চলে আসতে পারতেন এবং আনলিমিটেড আড্ডাও দিতে পারতেন। আড্ডাবাজি এবং হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যেই অফিসের সব কাজকর্ম চলতো। এমনকি বইমেলার তুমুল ব্যস্ততার দিনগুলোতেও আড্ডা চলতো বিরামহীন।  যুগপৎ  আমাদের প্রকাশিত বই এবং কাজের ধরনের কারণে পুরোমাত্রার ব্যাবসায়িক প্রকাশনীর পরিবর্তে শুদ্ধস্বর পরিচিত হয়ে উঠেছিল ‘অ্যাক্টিভিস্ট প্রকাশক’ হিসাবে। 

আবার সেই দুপুরের কথায় ফিরে আসি৷ তারেককে দেখলাম চলমান আড্ডার মাঝেই সে তার হোম অফিস পর্ব চালিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর অফিস সহকারীকে দিয়ে আবার কিছু স্ন্যাক্স আনিয়ে খেলাম সবাই। সাথে গরম চায়ের ধোঁয়া তো ছিলই । এই পর্বের খাওয়া-দাওয়ার পর সবার মধ্যেই খানিকটা এলায়িত-বিশ্রামের ভাব চলে এসেছিলমনে হয়। পারস্পরিক  কথাবার্তা তেমন হচ্ছিল না, সবাই কেমন যেন ঝিমানো ভাব নিয়ে বসেছিলো। ঐ সময় শুদ্ধস্বরের প্রাক্তন কর্মী ওয়াফি শক্তি এলো। সে অবশ্য মাঝে মধ্যেই আসতো। সেই সময় সে বিডিনিউজ ২৪.কমে এ কাজ করতো। বিডিনিউজের কোনও একটি সংকলন প্রকাশের প্রক্রিয়া চলছিল শুদ্ধস্বর থেকে। শক্তি বললো সেটার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে এসেছে।  আবার শুদ্ধস্বরের সে সময়ের অফিস সহকারী রাসেলকে শক্তিই জোগাড় করে দিয়েছিলো। এখানে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো, কিছুদিন আগে ব্লগার ও শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত ‘মুসলিম বিশ্বের জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই‘ এবং ‘শাহবাগ রাষ্ট্র প্রকল্প’ বইয়ের লেখক পারভেজ আলম যখন নেদারল্যান্ড যাবার আগে আমার সাথে বিদায়ি সাক্ষাৎ করতে এসেছিল, তখন পারভেজ চলে যাওয়ার পর রাসেল আমাকে বলেছিল, ‘ভাইয়া, এই লোক তো আমাদের এলাকায় থাকে। এই লোক তো নাস্তিক।‘ রাসেলের সেই কথাটা এখনো আমাকে ভাবায়। 

আবার আড্ডার প্রসঙ্গে ফিরে যাই৷ অন্তিম অক্টোবরে আমাদের সেই আড্ডার ঝিমুনি ভাবের মধ্যে আমি বোধ হয় টেবিলে মাথা রেখে ক্লান্তি তাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। এই ঘোর লাগা অবস্থাতেই টের পেলাম আমার মাথা দিয়ে অঝোর ধারায় রক্ত পরছে। আমি আমার অফিসরুমের চেয়ার ও টেবিলের মাঝখানে পড়ে গিয়েছিলাম। হৈ-হল্লার শব্দ কানে আসলো। সবুজ-কালো চেক শার্ট পড়া একজনকে দেখতে পেলাম। এরপর বা আগে আর কিছু মনে করতে পারছি না। এই সময়টা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি কিন্তু এর বাইরে আর কিছুই মনে করতে পারিনি। হয়তো জীবনের ভয়াবহ অনেককিছু আমরা মনে রাখতে পারি না, হয়তো মনে থাকলে  পরবর্তী জীবনে সুস্থ নিশ্বাস নেওয়া সম্ভব হয় না। আমি মনে হয় একটা শূন্য অবস্থায় খাবি খাচ্ছিলাম কিন্তু এটা ঠিকই টের পাচ্ছিলাম সে-ই শূন্যতার শরীর থেকে ছিটকে পড়া রক্তে ভেসে যাচ্ছি আমি ও আমার সময়। 

পরে শক্তি ও রাসেলের কাছে শুনেছি, যারা আক্রমণ করেছিল তারা অফিসে ঢুকেই বলেছিলো, “আমরা মুরতাদ টুটুলকে হত্যা করতে এসেছি”। এই উক্তিটা তখন শক্তি, রাসেলের বরাত দিয়ে বিডিনিউজ ২৪ সহ কোনো কোনো পত্রিকাও প্রকাশ করেছিল। এর পরের যে দৃশ্যটা মনে আছে সেটা হলো, একটা পুলিশ ভ্যানের পিছনের সিটে আমি বসে আছি। একজন পুলিশ আমাকে ধরে আছে। অনবরত রক্ত পড়ছে। কোথা থেকে রক্ত পড়ছে, বুঝতে পারছি না। নিজে থেকে নড়তে চড়তে পারছিলাম না তখন আর। উলটো দিকের সিটে রণদাকে বসে থাকতে দেখলাম। দুই সিটের মাঝখানে কমলা রঙের টিশার্ট পড়া তারেক শুয়ে ছিলো। তারপর আবার ‘কমপ্লিট ব্ল্যাক আউট’ যেনবা। এরপর যখন চোখ মেলে তাকালাম তখন দেখি আমাকে ঘিরে আছে একদল মানুষ। কাউকে কাউকে চেনা মনে হলো। তখন মোটামুটি কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা টের পেতে শুরু করলাম। গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক ইমরান এইচ সরকারকে দেখতে পেয়ে বললাম, ‘সবাইকে বলে দেবেন, আমি থামবো না, আমি বই প্রকাশ বন্ধ করবো না।‘  শুনেছি ইমরান সরকার একটি টিভি চ্যানেলের টক শোতে আমার এই বার্তাটুকু উদ্ধৃত করেছিলেন।     

৩১অক্টেবর – ১১ নভেম্বর ২০১৫:

এখানে আমি প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ও গুরুতর আহত আমার স্মৃতি থেকে এক দশক আগের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর বিবরণ বর্ণনা করবো। বাংলাদেশ হয়তবা তার ইতিহাসের ডায়েরিতে টুকে রাখবে রক্তে আঁকা সেই সময়ের কথা। সেই সময় কেবল কষ্টেরই নয়, লড়াইয়ের সাথীদের জন্য সে সময় আমার জন্য অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎসও বটে।

৩১ অক্টোবর ২০১৫। শনিবার দুপুরে আমি, রণদা (রণদীপম বসু) এবং তারেক রহিম ৮/১৩, ব্লক সি, লালমাটিয়া ঢাকার চতুর্থ তলায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে আমার কক্ষে বসে কথাবার্তা বলছিলাম। আমার অফিসে কর্মরত রাসেল, প্রাক্তন স্টাফ ওয়াফি শক্তির বর্ণনা এবং পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী জানতে পারি, একজন তরুণ প্রথমে অফিসের দরজা নক করে বা কলিং বেল বাজায়। রাসেল দরজা খুলে দিলে তরুণটি একটি বইয়ের তালিকা এগিয়ে দিয়ে বলে এই বইগুলো সে কিনতে চায়। এখানে উল্লেখ্য যে, লালমাটিয়ার শুদ্ধস্বর কার্যালয়টি নিয়মিত বই-বিক্রয় কেন্দ্র না হলেও মাঝেমধ্যে অনেকে এখান থেকে বই ক্রয় করতে আসতেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন এবং সোশাল মিডিয়ায় শুদ্ধস্বরের বিজ্ঞাপনগুলোতে কার্যালয় হিসাবে লালমাটিয়ার ঠিকানাও দেয়া থাকতো। রাসেল বইয়ের তালিকা দেখতে থাকার সময় সেখানে হঠাৎ আরও একজন এসে উপস্থিত হয়। এসময় রাসেলের সাথে শক্তিও উপস্থিত ছিলো। একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শনিবার ছুটির দিন বলে অফিসের অন্য স্টাফরা সেদিন অনুপস্থিত ছিলো। তখন আগন্তুক প্রথম তরুণ বলে দ্বিতীয় আগন্তুক তার ভাই।  ততক্ষণে আরও কয়েকজন শুদ্ধস্বর অফিসে উপস্থিত হয় এবং তারা সম্মিলিতভাবে রিভলভার, চাপাতি ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন করে। রাসেল ও শক্তির ভাষ্যমতে, তাদের উভয়কে সন্ত্রাসীরা অফিসের স্টোর রুমে নিয়ে আটকে রাখে। এসময় ঘাতকের দল “আমরা মুরতাদ টুটুলকে হত্যা করতে এসেছি”-এরকম দম্ভোক্তি করে  বলে শক্তি ও রাসেলের বরাত দিয়ে তখনকার পত্রপত্রিকা রিপোর্ট করেছে। 

ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটেছিলো যে শক্তি ও রাসেলকে আটক করে আক্রমণকারীরা আমার কক্ষে প্রবেশ করে এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই টেবিলে মাথা রেখে বিশ্রাম নেওয়া অবস্থাতেই আমাকে আঘাত করা হয়। রণদা এবং তারেক যতটুকু পেরেছেন প্রাণপন প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন। সেদিন তারেক ও রণদা না থাকলে আক্রমণকারীরা তাদের লক্ষ্য পূরণ করে যেত কোনো ঝামেলা ছাড়াই।  রণদার হাতে এবং শরীরের অন্যান্য জায়গায় চাপাতির আঘাত লাগে এবং আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার জন্য চেয়ার ছুঁড়ে মারতে গিয়ে পায়ে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন। রণদার হাতে পরে কয়েকবার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। আঘাতের এই সব চিহ্ন প্রিয় রণদাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। অফিসে আমার রুমের দুইটা দরজা ছিলো। তারেক কোনো একটা দরজা দিয়ে সামনের বারান্দায় চলে এসেছিল। তারেক হয়তো ভাবতে পারেনি বারান্দায়ও আক্রমণকারী দলের কয়েকজন পাহারায় ছিলো। ওরা তখন তারেককে চাপাতি ও ছুরি দিয়ে নির্মমভাবে আক্রমণ করে। তারেক আক্রমণ ফেরাতে গেলে তার শরীর এবং বিশেষ করে হাত সাংঘাতিকভাবে আঘাতগ্রস্থ হয়। আক্রমণকারীরা তারেককে উদ্দেশ্য করে গুলিও করে। সেই গুলি তারেকের কোমরে লাগে। সবমিলিয়ে শেষপর্যন্ত তারেকই সেইদিন সবচেয়ে বেশি আহত হয় এবং তার অবস্থা সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যায়। পরে শুনেছি, আক্রমণকারীরা আমাকে উদ্দেশ্য করেও গুলি করেছিল। কিন্তু গুলি আমার সামনের টেবিলের কাচে স্লিপ করে দেয়ালে গিয়ে লাগে। 

 আমাকে ঘটনাগুলোর কোনোকিছুরই প্রত্যক্ষদর্শী বলা যাবে না। আমি ঘাতকদের কিলিং মিশনের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিলাম এবং প্রথমেই আমাকে যেভাবে আঘাত করা হয়েছিল তাতে আমার সম্বিত ছিল না বলে কোনও কিছুই নিজ চোখে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। পুরো একটা নিকষ অন্ধকার অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম আমি। পত্রিকার রিপোর্ট এবং ঐ ভয়ংকর সময়ে উপস্থিতদের কাছ থেকে পরবর্তীতে যা শুনেছি, যেভাবে শুনেছি সেভাবেই ঘটনাগুলো লিখতে চেষ্টা করলাম। তবে প্রত্যক্ষদর্শী কারো কথাই আমার পক্ষে রেকর্ড করে রাখা সম্ভব হয়নি। 

হাসপাতালের কেবিনে তারেক রহিম

হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা অর্থাৎ সেলাই-ড্রেসিং ইত্যাদির পর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে শুয়ে আছি। মাথা-মুখ ব্যান্ডেজ করা, সারা শরীরে ব্যথা, কানে শুনতে পাচ্ছি না এবং প্রচুর লোকজন ঘিরে থাকা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় নিঃসাড় শুয়ে ছিলাম তখন। পরিচিত বন্ধুবান্ধব কয়েকজনকে দেখলাম কাছাকাছি। একসময়ের বন্ধু ও পরবর্তীতে ভায়রাভাই সাজ্জাদ হোসেন দোদুল, লেখক আহসান কবীর, স্কুল-বন্ধু ও লেখক সত্যজিৎ বিশ্বাস রানা এরা ছিলো। নিজেরা করি’র নির্বাহী খুশি কবীর আপা ছিলেন, ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন সভাপতি লেখক বাকী বিল্লাহ ছিলেন। শাকিলভাই (কবি ও তৎকালীন সরকারপ্রধানের বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল, তার সাথে আমার সরাসরি পরিচয় ছিলো না, মাঝে মধ্যে ফেসবুকের ইনবক্সে কবিতা নিয়ে মন্তব্য পাঠাতেন), তাঁকেও দেখেছি। খুশী আপার নিজেরা করি’র অফিস আমার অফিসের ঠিক বিপরীত পাশে। কিন্তু তাঁর সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো না। অপরিচিত সেই খুশী আপাই সেই সময় হয়ে উঠেছিলেন পরম আত্মীয়, বন্ধু এবং আশ্রয়। বাকী (বাকী বিল্লাহ) সবকিছু তদারকি করছিল। রক্ত জোগাড় করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য অনেক খুঁটিনাটি যা ঐরকম পরিস্থিতিতে অনেকে ভাবতেও পারে না সেসবেরই সমন্বয় করেছিল বাকী। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের রাতেও বাকীকে হাসপাতালে সক্রিয় দেখেছিলাম।

হাসপাতালে রণদীপম বসু

থেকে থেকে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার। আবার চারপাশের হল্লা শুনে জেগে উঠারও চেষ্টা করছিলাম। সেই ছোটোবেলা থেকেই আমার শরীরে এনেস্থেসিয়ার প্রভাব খুব বেশি সময় কাজ করে না। পোকায় খাওয়া দাঁত ফেলার সময় কতবার যে ইনজেকশন দেয়ার পরও ব্যথার কারণে ডাক্তার দাঁত উঠাতে পারিনি। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীও তখন আমাকে, আমাদেরকে দেখতে এসেছিলেন। প্রচুর রক্তপাতের কারণে ‘রক্ত লাগবে’- এমন ঘোষণার সাথে সাথে পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই তখন আমাদের জন্য রক্ত দিয়েছিলেন। যার এবং যাদের রক্তের পুনর্সিঞ্চনে সেদিন পুনরায় প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছিলাম তাদের জন্য সবসময় আমার ও আমাদের মনে ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতার অনুরাগ প্রবাহিত হয়। ক্যানোলা দিয়ে শরীরে ঢুকছে রক্ত এবং অন্যান্য ঔষধ, শরীরের প্রতিটি অংশে ব্যথা, ঘুম আসছে না, সবকিছু আবছা আবছা লাগছে, আমার বেডের ডান বা বা পাশের এক বেড পরে তারেক শুয়ে আছে, তারেককে ঘিরে আছে সচলায়তনের ব্লগার বন্ধুরা, আমি যেন ঘোরের ভিতর, কেউ তাড়া করছে এমন ভয়ডর অনুভব করছি না, ভাবছি হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার পর বই-মিছিল করবো, বই বিক্রি ও অন্যান্য ইভেন্ট করা যায় এমন একটা মাল্টি ফ্যাসিলিটেটেড আউটলেট করবো, তৃণমূলের পাঠকদের সাথে বই নিয়ে মতবিনিময় করবো, আরো কত কী, কত কত কী! মনে হচ্ছিল বইকে কেন্দ্র করে সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলা সম্ভব হবে। তখন মনে হচ্ছিল আমি সব পারব, পালটে দিতে পারব ঘুণে ধরা সমাজ, বদলে দিতে পারব বাংলাদেশ। ভেতর থেকে যেন এক অদৃশ্য শক্তি, তীব্র গতি আমার শিরায় শিরায় ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। সে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। দূরপ্রবাসে  এখনো প্রায়শই সেই অনুভূতির স্মৃতি জেগে ওঠে, ভাবি অনুভূতিটা যদি আবারও ফেরত পাওয়া যেত! পৃথিবী বদলানোর স্বপ্ন দেখতে এবং সেই স্বপ্নের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে এই অনুভুতিটুকু খুবই প্রয়োজনীয়। 

অমন ঘোর লাগা অবস্থাতেই রাত কেটে গেলো। একসময় আমিও বুঝতে পারলাম যে এটা দিনেরবেলা। রাতে আমার কাছে  রুনা ছিলো। আর কে কে ছিলো সেটা এখন আর মনে করতে পারছি না। বাঁ’দিকে তাকালেই দরজা বা জানালা দিয়ে বারান্দা দেখা যাচ্ছিল। আমি তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে। বারান্দায় এক টুকরা ম্লান সূর্যের আলো গড়িয়ে পড়েছে তখন। আমি রুনার কাছ থেকে তারেক ও রণদার খবর নিচ্ছিলাম। এমন সময় রুনা আমার হাত ধরে প্রকাশক বন্ধু ফয়সাল আরেফিন দীপনের খবরটা জানালো। বলল, গতকাল যে সময়টাতে শুদ্ধস্বরের অফিস আক্রমণ করা হয়েছিল সেই সময়েই আজিজ সুপার মার্কেটের জাগৃতির অফিসে দীপনকে নৃশংসভাবে  হত্যা করা হয়। দীপন সেসময় একা ছিলো। খবরটা শুনা মাত্র আমার রক্তের উষ্ণ প্রবাহ থেমে গিয়ে যেন জমাট বরফশীতল হয়ে গেল। আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না।  স্তব্ধতা, অনেক বেশি শূন্যতা ঘিরে ধরছিল কেবল৷ 

আমার বারবার মনে হচ্ছিল, গত সন্ধ্যায় আমরা তিনজন যখন মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে বেঁচে থাকার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই মর্গে শুয়ে ছিলো প্রিয় দীপনের নিথর দেহ। আগের দিনই দীপন এবং পলল প্রকাশনীর খান মাহবুব ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। আমি ভেবে রেখেছিলাম, অফিস শেষে শাহবাগে যাবো। হেমন্তের বইমেলা নিয়ে দীপন এবং মাহবুব ভাইয়ের সাথে কথাবার্তা বলবো। পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে সাড়া জাগানো ‘হেমন্তের বইমেলা’র মূল উদ্যোক্তা ছিলেন এই দুইজন। দীপন হত্যার পর এই বইমেলাটা আর অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে শুনিনি। যতটুকু মনে পড়ে দীপনের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৫-এর মার্চের ১ তারিখে। অপরাজেয় বাংলার সামনে তখন প্রিয় অভিজিৎ রায়কে শেষ বিদায় জানাচ্ছিলাম আমরা। এখান থেকেই অভিজিৎকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে অভিজিৎ এর শোকার্ত পিতা অধ্যাপক অজয় রায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য পুত্রের মরদেহ হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। সেইদিন দীপনের সাথে নানা জায়গা থেকে আসা হুমকি বিষয়ে কথা হয়েছিল। দীপন আমাকে বলেছিলো সেও হুমকি পাচ্ছে এবং এ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করে রেখেছে। এর বেশি দীপন আর কিছু বলেনি। অভিজিৎ রায়ের মতো দীপনের হাসিমুখ আর দেখতে পাব না কোনওদিন, এটা ভাবতে পারছিলাম না৷ আজও পারি না৷ দীপন হত্যার খবর শোনার পর সেদিনই একটা ছোট কবিতা লিখেছিলাম। লিখেছিলাম বললে ভুল হবে কারণ তখনও আমার শারীরিক অবস্থা কীবোর্ড, মোবাইলের বাটন বা কাগজ-কলম হাতে নেয়ার জন্য যোগ্য হয়ে উঠেনি। আমি মুখে মুখে বলেছিলাম কবিতাটা। রুনা সেটা মোবাইলে লিখে দিয়েছিল। কবিতাটা সেসময় অনেকগুলো পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছিল। 

হেমন্তের রাতে
কয়েক হাত দুরে
মর্গে দীপন
জরুরী ওয়ার্ডের স্বর্গে
আমরা তিনজন।

হাসপাতালে সেদিন আমাদের কেবিনে স্থানান্তরের জন্য চেষ্টা করছিল সবাই। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে কিছু সন্দেহজনক লোকজনের উপস্থিতি সবাইকে আতঙ্কগ্রস্ত করে দিয়েছিলো। আগের দিনই নাকি  জাহাঙ্গীর কবীর নানক এবং মাহবুবুল হক শাকিল ভাই কেবিনের ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ টালবাহানা করছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কেবিন পাওয়া গিয়েছিলো। ঠিক কোন সময় কেবিনে স্থানান্তরিত হয়েছিলাম সেটা এখন আর মনে করতে পারছি না। কেবিনে যাওয়ার পর শুরু হলো পরিদর্শনের পালা। বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রীরা দেখতে আসা শুরু করলেন  আহত আমাকে। তারা আসেন এবং সাথে আসে বিশাল লটবহর। সাংবাদিকরাও আসে। পরিদর্শনের যথাযথ ভিডিও ফুটেজ এবং ছবি তোলার জন্য কোনও কোনও সাংবাদিক আমার বিছানায়ও উঠে পড়েন। কারা কারা এসেছিলেন সবার কথা মনে নেই। তবে আমার নিজ জেলা সিলেটের কোনও মন্ত্রী বা সাংসদ আসেননি সেটা মনে আছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বেশ বড়োসড়ো একটা ফলের ঝুড়ি পাঠিয়েছিলেন। তবে নভেম্বরের ৩ তারিখে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদ সম্মেলনে ব্লগার হত্যা বিষয়ে প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছিলেন তার সাথে মন্ত্রীদের এই পরিদর্শন ও সমবেদনায় পার্থক্য সুস্পষ্ট ছিল। 

কেবিনে যাওয়ার পর একদিন নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক সাংবাদিক আসলেন আমার সাক্ষাৎকার নিতে। তাকে নিয়ে এসেছিলেন সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক। এর আগে সম্ভবত ১ নভেম্বর প্রথম আলো’র শওকত হোসেন মাসুমভাই রুনাকে ফোন করে একটা সাক্ষাৎকারের জন্য আমাকে রাজি করান। সেমসয় আসলে কথা বলাটা খুব কষ্টকর ছিলো। কিন্তু আমি আমার মনে জমা হওয়া কথাগুলো বলতেও চাচ্ছিলাম। আমি চাচ্ছিলাম আমার অবস্থান, অনুভূতি এবং অঙ্গীকার স্পষ্ট করতে। কারণ ঘাতকদের আক্রমণে মরে না গিয়ে বেঁচে যেতে পারাটা আমার কাছে বিশাল এক দায়িত্বের মতো মনে হচ্ছিল। সেজন্য মাসুমভাইয়ের অনুরোধ মতো কথা বলতে রাজি হই। মাসুমভাই সাংবাদিক শেখ সাবিহা আলমকে পাঠান। কানের ভিতরে রক্ত জমে থাকার কারণে সাবিহার প্রশ্নগুলো শুনতে আমার সমস্যা হচ্ছিল। তারপরও রুনার সাহায্য নিয়ে আমি প্রশ্নগুলোর উত্তর দেই। পরেরদিন প্রথম আলো আমার এই সাক্ষাৎকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ বড়ো করে ছাপিয়েছিলো। আমি বলেছিলাম, ঘাতকরা কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে হামলা করেনি বরং নির্দিষ্ট  আদর্শ-তাড়িত হয়ে আমাদের আঘাত করেছে। তাই আমাদের লড়াইটা অবশ্যই আদর্শিক। রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে মুক্তচিন্তার এ লড়াইয়ে মানুষের মন জাগানোর অঙ্গীকার নিয়ে আমি বই প্রকাশ অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, “আমি পিছু হটব না”।

আমার সাথে নভেম্বর ২০১৫-তে কথা বলার প্রেক্ষিতে নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত সে বছরের ডিসেম্বরে। আমি তখন নেপালে। নেপালি টাইমসের সম্পাদক কুন্ডা দীক্ষিত আমাকে খবরটি তখন জানিয়েছিলেন। হাসপাতালে প্রতিনিয়তই নতুন কিছু শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলাম। আবার মাথা ও মুখের আঘাতের ক্ষত ক্রমশ সেরে উঠছিলো। তবে কানের ভিতর ঢুকে থাকা রক্ত শুকিয়ে ভরাট হয়ে ছিল। এ বিষয়ে ডাক্তাররা আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে বললেন। ​কা​নের রক্ত বের করা হয়েছিল নেপালের একজন ইএনটি বিশেষজ্ঞের কাছে। কুন্ডা দীক্ষিত আমাকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। নেপালে থাকার সময় কুন্ডা দীক্ষিতনানাভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন। নেপালে থাকার সময়ে আরও সহযোগিতা পেয়েছিলাম ব্লগার বন্ধু এবং নেপাল অক্সফামে কর্মরত আসাদুজ্জামান তাজভাইয়ের। এসবের বিস্তারিত অন্য পর্বে লেখা হবে।   

যে কথা বলছিলাম। নভেম্বরের সেই হাসপাতাল-বাসের সময় রুনা খেয়াল করলো কিছু সন্দেহভাজন মানুষ নিয়মিত কেবিনের সামনে ঘুরাঘুরি করে এবং রুনা যখন বাইরে যায় বা বাইরে থেকে আসে তখন তাকে এমনভাবে অনুসরণ করে যা রুনার মনে ভীতিকর অবস্থার জন্ম দেয়। এ বিষয়টি আমাদের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হলে পুলিশ সার্বক্ষণিকভাবে কেবিনের সামনে দুইজন পুলিশকে পাহারা নিযুক্ত করে। কিন্তু পাহারা হয়ে গেলো নতুন ঝামেলার কারণ। পুলিশরা ক্ষণে ক্ষণে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দাবি করতে থাকলেন। যে দাবিগুলো পূরণ করা আমাদের পক্ষে সেসময় অসম্ভব ব্যাপার ছিলো প্রায়। একদিন গভীর রাতে দরজায় নক করে আমাদের জাগিয়ে তুলে তারা বললেন তাদের মশার কয়েল দিতে হবে। কিন্তু ঐ সময় আমরা কয়েল পাবো কোথায়! আরেকদিন একইভাবে গভীর রাতে জাগিয়ে তুলে বললেন তাদের ফ্যান সরবরাহ করতে। একদিন রাত ২টার দিকে মোহাম্মদপুর থানার ওসি এসে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে আমার উপর আক্রমণের ঘটনায় এজাহারের কাগজে স্বাক্ষর করতে বললেন। আমি বলেছিলাম, ‘রেখে যান। পরেরদিন দিনের বেলায় স্বাক্ষর করবো।’ কারণ লিখিত এজাহারের কিছু বিষয়ে আমার আপত্তি ছিল। কিন্তু ওসি এক প্রকার জোর করেই সেই রাতেই আমাকে দিয়ে এজাহারে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিলেন। এই এজাহারের কোনো তথ্য আমার আর জানা হয়ে উঠেনি কোনোদিন। এদিকে সন্দেহভাজন লোকজনের উপস্থিতি খুব স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যাচ্ছিল। আমাকে যারা দেখভাল করছিলেন তারা সবাই বিষয়টি বুঝতে পারছিলেন। এই অবস্থায় বাকী বিল্লাহ তার কর্মী কয়েকজন অনুজপ্রতিমকে নিয়োজিত করেছিল আলাদা করে নজরদারি করার জন্য। এরই মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো আমাকে রিলিজ দিতে। হাসপাতালের পরিচালক প্রতিদিন সকালবিকাল পরিদর্শন করতে আসেন এবং বলেন আমার এখন চলে যাওয়া প্রয়োজন। এই অবস্থার মধ্যেই একবার আমাকে সিসিইউ ওয়ার্ডে স্থানান্তরের প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার কারণে আমি যেতে অসম্মতি প্রকাশ করি। 

এর মধ্যে একদিন আইকর্ন (The International Cities of Refuge Network (ICORN) থেকে রুনার কাছে একটা ইমেইল আসে। তারা আমাকে নরওয়ের সিয়েন শহরে গেস্ট রাইটার হিসাবে রাইটার্স স্কলারশিপের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এই মেইলের খবর জানার পর আমার ভেতর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। আমার জানা মতে,  যুক্তি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক, লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ আইকর্নে আবেদন করেছিল। তারা তাকে অপেক্ষায় রেখে দিয়েছিল। এবং এই অপেক্ষায় থেকেই অনন্তকে ঘাতকদের হাতে নিহত হতে হয়েছে। আমি আবেদন পাঠিয়েছিলামদুই মাস আগে, জুলাই মাসের শেষের দিকে। জেসমিন আপা ( লেখক-অনুবাদক জেসমিন চৌধুরী) আমাকে সাকি ভাইয়ের (সাকি চৌধুরী) সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সাকিভাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন স্নিগ্ধার সাথে। স্নিগ্ধার পরামর্শেই আমি আইকর্নে আবেদন করি। কিন্তু তারা একটা আনুষ্ঠানিক উত্তর দেয়। বলে জায়গা খালি নেই, ইত্যাদি। এর মধ্যে স্নিগ্ধা একদিন আমাকে জানিয়েছিল কারা নাকি রিপোর্ট করেছে যে আমি আসলে বিপদগ্রস্থ না। আইকর্নের মেইলের খবর তাই আমার মধ্যে আলাদা কোনো আনন্দ বা উত্তেজনা তৈরি করে না। আমি রুনাকে বলি এখন আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাকে এখন অনেক কাজ করতে হবে। আমার এই প্রতিক্রিয়ার পর খুশী আপা, বাকী ও অন্যরা আমার সামনে পরিবর্তিত  পরিস্থিতির ভয়ার্ত বাস্তবতা তুলে ধরেন। অভিজিৎ রায়ের জীবনসঙ্গী, লেখক বন্যা আহমেদ মেইল লিখে বলেন, বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে হবে। একপর্যায়ে আমি সম্মত হই এবং আইকর্নকে সম্মতি জানিয়ে জবাব দেই। এই অবস্থায় খুশীআপা, বাকী বলেন আমার টেম্পরারি রিলোকেশনে চলে যাওয়া প্রয়োজন এবং সেটা খুব তাড়াতাড়ি।

প্রথমেই মাথায় এলো ভারতের কথা। ভারতে গেলে চিকিৎসাটা করা যাবে এটাই ছিল প্রধান বিষয়। কিন্তু ভারতের ভিসা- প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং জটিল। সবাই বললো সেটুকু সময় অপেক্ষা করা সঙ্গত হবে না। কারণ নিরাপত্তা সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত নেপালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় । কারণ নেপালে অন অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়া যায়। আমার মনে পড়ে এর আগে বিয়ের পর হানিমুনে গিয়েছিলাম নেপাল। আর এবার যেতে হবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। হায় জীবন! জীবন এরকমই সতত পরিবর্তনের স্রোতে ভাসে৷

খুশী আপারাই সব ব্যবস্থা করে দেন। ব্লগার বন্ধু কৌশিক আহমেদকে দেখলাম এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে। মাত্র কিছুদিন আগে, সম্ভবত ২০ বা ২১ অক্টোবর কৌশিকের সাথে দেখা হয়েছিল ইয়োলো’র ধানমন্ডি আউটলেটে। রুনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে ওর জন্য জামা কিনতে গিয়েছিলাম সেখানে। যাক,  খুব দ্রুত সব ব্যবস্থা হয়ে গেলো।

হাসপাতালে আমি, তারেক ও রণদা তিনজন তিন কেবিনে ছিলাম। কেবিনে নেয়ার পর আমার সাথে আর কারো দেখা হয়নি। আহা, কত কত দারুণ সময় কেটেছে আমাদের। বাংলাদেশের ব্লগ সংস্কৃতির অনলাইনের বাইরের যোগাযোগ, সংযোগ, আড্ডার একটা বিশাল অংশের সাক্ষী হয়ে ছিলাম আমরা এবং আরো অনেকে। 

হঠাৎ নিজেকে মনে হলো ভাসমান হয়ে গেছি। মনে হলো আমি আর আমার জায়গায় নেই, পায়ের নিচে মাটি নেই। নিজের কাছে নিজেকে অনাহুত মনে হতে থাকলো। এখানে একটা প্রসঙ্গ বলে রাখা প্রয়োজন যে, জুলাই-আগস্ট মাসে যখন আমি সাংঘাতিক নিরাপত্তা সংকটের মধ্যে চরম হতাশা ও অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম তখন আমাদের এক বন্ধু ফোন করে বলেছিলেন, একজন বিশিষ্ট ব্লগার ও গণজাগরণের নেতা তাকে বলেছেন আমি (টুটুল) যদি বিদেশ যেতে চাই তাহলে যেন তার সাথে যোগাযোগ করি। যদিও ঐ ব্লগার ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চিনতেন, এমনকি আমার বাসায়ও এসেছেন দু’একবার। কিন্তু তিনি নিজে থেকে আমার সাথে কথা বলেননি। ঐ সময়েই একজন সংবাদকর্মী ও লেখক আমাকে বলেছিলেন তাকে একজন বলেছেন লাখ পাঁচেক টাকা খরচ করলে বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। তিনি এও বলেছিলেন,ভারতের পশ্চিম বঙ্গে আধার কার্ড পাওয়া সহ জমি বা ফ্ল্যাট কেনার চ্যানেলও তার জানা আছে। এগুলো সবই আমার কাছে তথ্য হিসাবে এসেছে। আমি কারো সাথে এ বিষয়ে কথা বলিনি বা যোগাযোগ করিনি। আমি গিয়েছিলাম একজনের কাছে এই পরিস্থিতিতে কী করতে পারি- এই বিষয়ে পরামর্শ চাইতে। তিনি একটা মানবাধিকার সংস্থার স্থানীয় প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি আমাকে অনুদানের কথা বলেছিলেন। আমাকে ইমেইলে ফর্মও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেটা কখনো ফিলাপ করেও পাঠাইনি। এখানে বিষয়গুলো উল্লেখ করছি এ কারণে যে, এই তথ্যগুলো গণজাগরণ মঞ্চের উত্তাল আন্দোলন পরবর্তী বাংলাদেশের অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগারদের বিদেশ যাবার প্রবণতার কিছু তথ্যসূত্র হিসেবে কাজে লাগলেও লাগতে পারে। তো আমার ও আমার পরিবারের নেপাল যাওয়ার তারিখ-টিকেট সব যখন হয়ে গেলো তখন হাসপাতাল ছাড়ার সময়ও ঠিক হলো। কিন্তু ব্যাপার হলো নেপাল যাওয়ার আগে তিনটা রাত কোথাও থাকতে হবে। আমার নিজের বাসায় যাওয়া নিরাপদ নয়। আত্মীয়স্বজনরা নিরাপত্তার কারণে কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তির বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলো। কিন্তু কিছু কারণে আমি যেতে রাজি হলাম না। অবশেষে বাকীর মধ্যস্থতায় তার এক বন্ধু আমাকে আশ্রয় দিতে রাজি হলেন। ভদ্রলোক একটা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থায় কাজ করতেন। ডিসচার্জের সময় ঠিক করা হলো সন্ধ্যার দিকে। সেটা ছিলো নভেম্বরের ১০ বা ১১ তারিখ। আমার মাথা মুখের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সেলাইয়ের দাগগুলো তখনো ভয়াবহভাবে দগদগে হয়ে আছে। এ দাগ ঢেকে রাখার মতো নয়। কেউ একজন একটা ক্যাপ এনে দিলো। সেই ক্যাপ মাথায় দিয়ে এবং একটা চাদর দিয়ে মাথা-মুখ ঢেকে হুইলচেয়ারে করে হাসপাতাল থেকে বের হলাম। শাকিলভাই তার সরকারি গাড়ি পাঠিয়েছেন। কিন্তু কেবিন থেকে বের হতেই অনেকগুলো ক্যামেরা, টিভি ক্যামেরার মুখোমুখি হতে হলো। এত গোপনীয়তার সাথে বেরোনোর সময় ঠিক করার পরো কীভাবে খবর চাউর হলো বুঝতে পারলাম না। যখন গাড়ি চলতে শুরু করলো তখনো অনেকগুলো টিভি চ্যানেল আমার গাড়িকে চেজ করতে লাগলো এবং কোনো কোনো চ্যানেল লাইভ দেখানো শুরু করলো। ব্যাপারটা ছিলো খুবই আতঙ্কজনক এবং বিব্রতকর। এটা প্রচার করার মতো কোনো ইস্যু তো হতে পারে না। যাইহোক আবারও শাকিলভাইয়ের সহযোগিতা নিতে হলো। শাকিলভাই দ্রুত এই লাইভ এবং চেজিং বন্ধ করালেন। 

সন্ধ্যার পর পর গিয়ে পৌঁছুলাম সেই আশ্রয়দাতা ভদ্রলোকের বাসায়। তিন বা চারতলার ফ্ল্যাটে তিনি থাকেন। আমাদের (মানে আমার সাথে রাতে এসে রুনা থাকবে) জন্য একটি রুম ছেড়ে দিলেন। তিনি ও তার পরিবার খুবই আন্তরিক আতিথেয়তা দিয়ে আমাদেরকে বরণ করে নিলেন। সে রাত তো কেটে গেলো। পরদিন সকালে রুনা চলে গেলো বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে। ৩১ অক্টোবর আমার খবর শোনার পর রুনা বের হয়ে আসে। বাচ্চাদের রুনার ভাগ্নি মুনিয়া পল্লবীতে পাঠিয়ে দেয়। তখন থেকে বাচ্চারা সেখানেই আছে। আমার সাথে সেসময় আর মেয়েদের দেখা হয়নি। তাছাড়া আমরা মুখে না বললেও ভেতরে ভেতরে তো বুঝতে পারছিলাম, আমাদেরকে হয়তো চিরদিনের জন্যই দেশ ছাড়তে হচ্ছে। 

রুনা বাসায় যাবে। অন্তত কিছু কাপড়চোপড় তো সাথে নিতে হবে। কুড়ি বছরের সংসার, কত টুকিটাকি, কত সখের জিনিস, পারিবারিক স্মৃতি, আমার সংগ্রহের বইপত্র- সবই ছেড়ে যেতে হবে! রাতে রুনাকে পৌঁছে দিয়ে গেলো ভায়রাভাই দোদুল। দুজনেই বলল, গেটের বাইরে কিছু মানুষকে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। পরেরদিন সকালেও রুনা চলে গেল। এসময় দুইদিন খুশী আপা তার গাড়িটি রুনাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। এদিন সকালে ব্লগার কৌশিক, নাধ (নাস্তিকের ধর্মকথা) এবং নাধের স্ত্রী জেসমিন এলো আমার একটি সাক্ষাৎকার নিতে। নাধ তখন একটি তথ্যচিত্র বানাচ্ছিল। সাক্ষাৎকারটি বেশ প্রাণবন্ত হয়েছিল। শারীরিক দুর্বলতা, বিশেষত কানের ব্যথার কারণে আমি খুব কাহিল ছিলাম, তারপরও যথাসম্ভব গুছিয়ে বলেছিলাম। নাধের এই তথ্যচিত্র ডয়েচ ভেলের পুরস্কার পেয়েছিলো। কিন্তু আমার সাক্ষাৎকারটি তথ্যচিত্রটিতে রাখা হয়নি। আমি জিজ্ঞেস করাতে নাধ বলেছিল,ফুটেজ হারিয়ে ফেলেছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকাকালে বলা কথাগুলো তথ্যচিত্রটিতে না রাখাতে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।

সেদিন সন্ধ্যার পর আশ্রয়দাতা ভদ্রলোক এসে বসলেন আমার পাশে। গল্প করতে করতে তিনি আমার একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তারপর তিনি তার মোবাইল বের করে কয়েকটা মেসেজ দেখালেন। মেসেজগুলো ছিলো হুমকিস্বরূপ। এগুলো তিনি পেয়েছেন আমি তার বাসায় আসার পর। তিনি আরো বললেন, গতরাতে কিছু মানুষ এসে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করেছে, এই বাসায় নতুন মানুষ কে এসেছে?  ঐ লোকদের ব্যবহারও নাকি ছিলো বেশ উদ্ধত। রাতে রুনাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন রুনার সেজো দুলাভাই। এর পরের দিন সকালে রুনা আবার চলে গেলো। 

সেদিনই স্মৃতিময় ঢাকায় শেষ দিন। সবকিছু গোছগাছ সেদিনই শেষ করতে হবে। আমি তখনো শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল। মানসিক চাপ কেমন সেটা বলে বুঝানোর মতো নয়। কানে প্রচণ্ড ব্যথা এবং চোখেও কিছু সমস্যা বোধ করছিলাম। সারাটাদিন খুব চাপের মধ্যে কাটলো। একা একা শুয়ে শুয়ে কতশত স্মৃতি, কত স্বপ্ন যে হামলে পড়লো মনে তার ইয়ত্তা নেই! রাতে রুনার ফিরতে বেশ দেরি হলো। আমাদের দুজন আর কন্যা দুজন মোট চারজনের জন্য চারটে সুটকেস রেডি হয়েছে। বাকি সব পড়ে রইল, হারিয়ে গেল। এ যেন নদী শিকস্তির মতো অবস্থা। কষ্ট হলো  অনেক আবার এও ভাবনায় এলো, মানুষই থাকে না আর জিনিসপত্র! এতকিছুর পরও বেঁচে যে আছি তা-ই তো সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা।

রুনাকে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন রুনার সেজো দুলাভাই। গাড়ি ভেতরে ঢুকার সাথে সাথে গেটে উপস্থিত একদল অপরিচিত মানুষ। তারা দারোয়ানের কাছে জানতে চায় কে এসেছে! রুনা উপরে এসে আমাদের আশ্রয়দাতাকে ঘটনা অবহিত করে। আশ্রয়দাতা থানায় ফোন করে ওসির সাথে আলাপ করেন। ওসি তখন থানা থেকে একটি পেট্রোল জিপ পাঠালে রুনার দুলাভাই গাড়ি নিয়ে ফিরে যান।

সে রাতে আর ঘুম হয়ই না! পরেরদিন সকালসকাল তৈরি হয়ে যাই। মেয়েরা পল্লবী থেকে দোদুলদের সাথে বিমানবন্দরে যাবে। দোদুল আমাদের সঙ্গে যাবে বলে ঠিক হলো। দু-একদিন নেপাল থেকে আবার ফিরে আসবে। শাকিলভাইয়ের জিপ আসে আমাদেরকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়ার জন্য। আমাদের আশ্রয়দাতা ভদ্রলোক থানার ওসিকে বলে দুটি পেট্রোল জিপ আনান। তারপর সামনে পেছনে পুলিশ কর্ডন নিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছলাম নিরাপদে। মেয়েদের সাথে দেখা হলো। আমার বুক ভেঙ্গে কান্না আসছিল, কিন্তু কাঁদতে পারছিলাম না। ওরা অনেক ঘাবড়ে গিয়েছিল। দেখেই বুঝতে পারছিলাম ওদের উপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ গেছে।

বিমানবন্দরের  আনুষ্ঠানিকতা সব ঠিকঠাকমতো শেষ করে বিমানে উঠলাম । বিমান টেকঅফ করার পর মনে হলো, বুক থেকে বিশাল এক পাথর যেন নেমে গেল এবং সাথে সাথে বুক ভেঙে হুহু করে কান্নাও আসলো। একপ্রকার অস্তিত্বহীন  মনে হলো নিজেকে। যেন এক নিমেষেই আমার জীবন থেকে একটা বড় অংশ মুছে গেল, হারিয়ে গেল!

৩১ অক্টোবর  ২০১৫ আক্রমণের শিকার হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা সংকটের মুখে বিমানে উঠা পর্যন্ত সময়টা আমার কাছে বিগত কয়েক মাসের আতঙ্কের চেয়ে বেশি আতঙ্কজনক মনে হয়েছে। সার্বিক অবস্থা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হয়েছে দেশে একই সাথে অনেকগুলো সরকার যেন বিরাজ করছিল। যেখানে এক সরকারের সাথে আরেক সরকারের সমন্বয় নেই, জানাশোনা নেই। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় আমাকে দেখতে এসেছিলেন তৎকালীন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তাঁরা দুইজনেই বলেছিলেন, তারা মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও নিরাপত্তা সংকটে ভুগছেন। সবমিলিয়ে ব্লগার হত্যা, আক্রমণ ইত্যাদি ঘটনাগুলোর সাথে সরকারের কোনো কোনো অংশের এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্টতার যে আলোচনা শুনেছি, তার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়ার অবকাশ থাকে না। হতে পারে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই ধর্মীয় উগ্রবাদিদের সাথে যোগসাজশে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছিল। একজন সাধারণ নাগরিক এবং একজন ভিকটিম হিসাবে আমি বাংলাদেশে ব্লগার, প্রকাশক, লেখকদের উপর আক্রমণ এবং হত্যাযজ্ঞ বিষয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু তদন্ত প্রত্যাশা করি। কিন্তু অবস্থা পর্যবেক্ষণে আমি বুঝতে পারছি যে, ব্লগার বা নাস্তিক কিলিং প্রকল্পের তদন্ত বা বিচার সম্পর্কে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কোনও অঙ্গীকার আগেও ছিল না এবং এখনও নাই। এছাড়া সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনও এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ফায়দা হাসিলের টোপ হিসাবে ব্যবহার করার পরামর্শ দেয় বলে আমার মনে হয়।    

অক্টোবর আসে, অক্টোবর চলে যায়। অক্টোবর ফিরে ফিরে আসে ক্যালেন্ডারের পাতায়, হেমন্তের ঝরা পাতার বিবর্ণ হতে থাকা রঙে। দেখতে দেখতে এক দশক হয়ে গেলো। এখনও স্মৃতি থেকে সরাতে পারি না অন্তিম অক্টোবর ২০১৫-এর সেই রক্তাক্ত দিন, সেই ঘাতক সময়। আবার ভুলতে পারি না, নভেম্বর ২০১৫-এর সেইসব দিন, বন্ধুস্বজনদের শুশ্রূষায়, সমব্যথার বোধে ও সক্রিয়তায় পুনরায় নিঃশ্বাস নিতে পারার আনন্দ। দেশ ছাড়তে ছাড়তে যে অব্যক্ত কান্নায় ভারী হয়ে ওঠেছিল বুক, সে বুক যেন খুঁজে ফিরছিল লেখার জন্য, বইয়ের জন্য, চিন্তার স্বাধীনতার  জন্য প্রাণ হারানো বন্ধু অভিজিৎ, অনন্ত, দীপন এবং আরও অনেককে। 

এখনও হেমন্ত আসে পৃথিবীতে। আমার পরিচিত পৃথিবীর জল-হাওয়া-সংস্কৃতি থেকে দূরে অন্য প্রান্তে বসে আমি ভাবি হেমন্তের হাহাকারে ভরা বাংলাদেশের কথা৷ সে হাহাকারে কোথাও কি লেখা নেই এই আমার কথা?

Scroll to Top