পথ

আকাশটা আজ আষাঢ়ের বউ হয়ে পাছা দোলাচ্ছে। মেঘের ঘাগরা পরা আকাশের কারণে সোয়েটার পরার মতো ঠান্ডা বাতাস ঘর ছেড়ে বেরুতে সায় দেয় না। এমন বিষণ্ণ, মনে না ধরা দিনেও আমাকে শেষ পর্যন্ত বেরুতেই হলো। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে ঘাড়ের বোঝা ঠিকঠাক মতো নামতে নামাতে শহরের অনেক সড়কেই পানি জমে এক হাঁটু। তা হোক। ভেসে যাক এই নগর, নাগরিক ব্যস্ততা। আমি ফাঁক বুঝে সুবিমল মিশ্র, অক্টাভিও পাজ এবং মাহমুদুল হকে চোখে বুলালাম। সাথে চললো চা ও সিংগারা। কিছুক্ষণ বেনসনের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিলাম চাপচাপ টেনশনের অংশ বিশেষ।
তার মানে, আমি, মানে হিরন্ময় পথিক ওরফে শুভ ভালই আছি। খাচ্ছি-ঘুমুচ্ছি। চা সিংগাড়ার সাথে বইয়ের পাতায় চোখ ফেলছি, বেনসনের ধোয়ায় টেনশন উড়াচ্ছি- সব মিলিয়ে ভালো নয়তো কি? হ্যাঁ, ভালো বুঝি ওই চন্দ্রিমা উদ্যানের প্রেম (!) যে গাছের গোড়ায় গায়ে গা লাগিয়ে বসলেই মনে হবে ভালো। স…ব ভালো। যে, ট্রাফিক সিগনালে একচান্সে সবুজ বাতি দেখেনি জীবনে তার আবার ভালো কোত্থেকে আসবে। ভালো তো পকেটের রুমাল নয়, হাত দিলেই বের হয়ে আসবে।
বাংলা মোটর মোড়ে রেড সিগনালে আটকা পড়ে মনে ভাসে তিথির ছবি। তিথি বোধ হয় এখনো জানে না ওর প্রতি আমার ভালবাসার কথা। থাক, না জানুক। তবুও সে এখন পর্যন্ত আমার প্রথম এবং একমাত্র ভাল লাগা। তবে ভবিষ্যতে কি হবে জানি না। কেননা পুরুষের মনতো। এবং আমি তো জলজ্যান্ত পুরুষই। যদিও তিথিকে কেন্দ্র করে এখনো অনেক সময় অদ্ভুত অদ্ভুত নষ্টালজিক স্বপ্ন কিংবা ঘোরে ডুবে থাকি। শেষ পর্যন্ত এই ডুবে থাকাই হয়তো সার। যদিও বাইচান্স কিছু একটা ঘটে যাওয়ার আশা মন থেকে তাড়াতে পারি না।
রিকশা ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। বা’পাশের আকাশছোঁয়া দালানটাকে পাশ কাটাতে কাটাতে মনে হলো আমাদের মাথার উপরে রডের আকাশ, ইলেকট্রিক বাতাসে আমাদের নিঃশ্বাস উঠছে নামছে। এজন্যেই বুঝি বুকের বাঁ’পাশটাতে এত ব্যাথা। মাটি কোথায়? কোথায় মাটির সোঁদা গন্ধ? তারপরেও থামে না আমাদের কংক্রীট জীবন। রিকশা ছুটে চলছে। ঘামে ও বৃষ্টিতে রিকশাওলার শার্ট পিঠের সাথে লেপ্টে গেছে। এমনকি কানের লতি বেয়েও নামছে ঘামের ধারা। আমার গাঁয়ে ফুর ফুরে বাতাসের আমেজ। হঠাৎ কে যেন ডাক দিলো-‌ ‌‌’শুভ’, এই শুভ। “চমকে উঠে চারদিকে তাকালাম। কে ডাকলো? রিকশার গতির চেয়ে দ্বিগুণ বিস্ময় আমার মনে দোল খেলো। তারপর মনে হলো, আমি নিজে থেকেই ভাবছিলাম -আমার এই শ্যাম্পু করা বাতাসে উড়া চুল, ফর্সা ফ্যাসনেবল কাপড় আর শেভ করা লোশনড গাল দেখে পরিচিত কেউ ডাক দিক। আসলে হয়েছে কি, এই অবচেতন কল্পনার কথা প্রায়ই মনে থাকে না আমাদের। যার ফলে নিজেকে কিছু এটা ভাবতে বেশ আরামই বোধ হয়।
আমাদের বাসার পাশেই ক্ষীণ স্রোতা একটা খাল ছিলো। খাল পাড়ের এটেল মাটিতে আমরা ঘর বাড়ি, রাস্তা ঘাট, নদী-পুকুর বানাতাম। বানানোর পর নাম দিতাম সোনার গাঁ। সোনার গাঁয়ের সোনার দিন থাকেনি বেশী দিন। তারপর লুংগি পরে ফুটবল, ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে মফশ্বল শহরের চৌরাস্তায় মার্শাল’ল উপেক্ষা করে মিছিলের উত্তেজনাও হারিয়ে গেছে। এবং শেষ পর্যন্ত পিস্তল-পাইপগান হাতানোর স্বাদ পাওয়ার আগেই মনে হচ্ছে মাথার উপরে রডের আকাশ, পায়ের নীচে কংক্রীট জমিন।
তারপরেও সবকিছু ছাপিয়ে উকি দেয় তিথি। ‌শুভ কেমন আছো? “-শুনতে শুনতে আন্তঃনগর ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দ হয়ে যায় রবীন্দ্র সংগীত।” আম্মা, এ হলো শুভ, চিনেছো তো। আমাদের বাসায় অনেক দিন গিয়েছে। “-বলতে বলতে তিথি খেয়াল করে শুভ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। শুভ’র মাথায় তখন আলী আকবর খাঁর সেতার, বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই আর বিটোফোনের সোনেটা- সব গুবলেট পাঁকিয়ে গেছে। এবং এই পাথর অবস্থাতেই শুভ তিথিকে জিজ্ঞেস করে। কেমন আছো?”
কেমন আছে তিথি? তিথির হলুদ ওড়না, ঠোঁটের লিপস্টিক, নকশাদার স্যান্ডেল চিৎকার করে বলে -ভালো খুব ভালো। একেবারে প্রধানমন্ত্রীর কার্য্যালয় “সুগন্ধার” মত ভালো। শুধুমাত্র গাঁদা ফুলগুলিকে যা একটু বিরক্ত লাগে। এছাড়া আর সব ঠিক ঠাক। গোলাপী শিফনের মতো মন, জর্জেট মেজাজ, ড্রাই করা হাসি-এসব নিয়ে কি আর খারাপ থাকা যায়?
তাহলে শুভ’র অবস্থাটা কি দাঁড়ালো? বৃত্তাবদ্ধ শৈশব, অবিকশিত কৈশোর, এবং ধাক্কা খাওয়া তারুণ্য নিয়ে কেমন আছে শুভ? শুভ, মানে আমি, মানে যে খাচ্ছে-ঘুমুচ্ছে, ফুকছে বেনসন সে কেমন আছে?
নিজের কথা আর কতটুকুই বা বলা যায়? রিকশা মগবাজার মোড়ে আসার পর সিদ্ধান্ত নিতে পারি না ডানে-বামে না সোজা যাবো। একদিকে তিথি, একদিকে বৈভব এবং অন্যদিকে সারিন্দার টুংটাং-এর মতো নিরুদ্বিগ্ন হাভাতের জীবন। কিন্তু মুশকিল হলো কে যে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে- আমি ঠিক ঠাহর করতে পারি না। ডানে-ছিমছাম রাস্তার গা ঘেষে রাষ্ট্রের উচ্চ পদস্থ কর্তা ও আমলাদের সুদৃশ্য আবাস। মন বলে ওদিকে যাই। কিন্তু আমার সাধারণ পা ওই অসাধারণ পথে যেতে সাহস পায় না। (আমি ততক্ষণে রিকশা থেকে নেমে গিয়েছি। পকেট ঝেড়ে রিকশাওলাকে বিদায় করতে গিয়ে পড়লাম বিপাকে। আমার হিসাব মতে প্রাপ্যের চেয়ে দুটাকা বেশী দেয়ার পরেও রিকশা ওলা আমাকে কেয়ামতের দিন দাবীর নীচে রেখে, ওর টাকা মেরে বড়লোক হতে পারবোনা-এই শাপ দিতে দিতে বিদায় হলো)। সোজা-ব্যস্ততা, গ্যাঞ্জাম- খালি মানুষের মাথা। রিকশার হুড আর কার- বাসের চলন্ত ছাদ। ছয় নম্বর বাসের কান ফাঁটা হর্ণে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। এ পথে এক্সপার্ট পকেট মারদের আনাগোনা উল্লেখ করার মতো। আমার ভীরু হৃদপিন্ড ওই পথে যেতে সায় দেয় না। এবং বামে আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য নাই। ভীড়, ব্যস্ততা, গ্যাঞ্জাম-কম বলা যাবে না। তবেই কাছেই একটা রেলগেট আছে। এবং রেল গেট পেরিয়ে কিছুটা সামনে গেলে দেখলেও দেখা যেতে পারে, শাবানা, ববিতা, শাবনাজ, মৌসুমী নামের প্রাণীদিগকে। অবশ্য আমার মতে, রেললাইনটাই জীবনের তাবৎ সমস্যার সমাধান হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন শুধু পিছুটানহীন একমুঠো সাহস। ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলেই সব ফকফকা।
যেদিন ২৬শে মার্চ সেদিন পার্কে ঢুকা নিষেধ, ১লা বৈশাখের কণ্ঠনালীতে বেয়নেটের বেরিকেড। বাঙালিকে গণতন্ত্র শেখানো হচ্ছে। যে গণতন্ত্রের ছোঁয়ায় হিরন্ময় পথিক ওরফে শুভ’র বুকের পশম কাঁপে , হাসতে হাসতে কাঁদতে ইচ্ছে করে। শুভ কোন দিকে যাবে ভেবে পায় না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এর মধ্যে সূর্য্য একবার উকি দিলেও আকাশের অবস্থা তথৈবচ। ঘড়িতে দুপুর গড়িয়ে গেছে। বৃষ্টি পড়ছে থেমে থেমে, মাঝে মধ্যে প্রচণ্ড ভাবে। শহরের কোন কোন রাস্তা নদী হয়ে গেছে। হায়! পদ্মায় পানি নাই এদিকে রাজধানীর রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেছে। নিউ মার্কেটের ভিতরে হাঁটু সমান পানি। তারপরেও কেনা কাটার কমতি নেই। কাপড়-কসমেটিক, রঙিন পেন্সিল এবং রবীন্দ্রনাথের “শেষের কবিতা” সবই বিক্রি হচ্ছে। এবং ফুটপাতের পলিথিনের ছাউনিওলা বাসিন্দাদের জীবনও চলছে ভাবলেশহীনভাবে।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শুভ’র অর্থাৎ আমার গায়ে জ্বর আসে। মাথায় অসংখ্য মানসিক যন্ত্রণার সাথে শারীরিক যন্ত্রণা জাড়িত হয়। তারপর অদ্ভুতভাবে আমি আমার যাবার পথ ঠিক করে ফেলি। তিথিতো কিছু দিনের মধ্যেই হোমরা-চোমরা কারো ঘরনী হয়ে যাবে। বৈভবের প্রচণ্ড ক্ষমতাও প্রয়োজন আছে মনে করেও এর প্রতি কোন টান অনুভব করি না। অতএব সমাধান রেললাইন।
অবশেষে হিরন্ময় পথিক ওরফে শুভ ভালয় ভালয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজে পৌঁছে। শুভ কোনদিন প্রমত্ত পদ্মা দেখেনি। আজ যা দেখছে তা আর নদী নেই ধু ধু বালুর মাঠ। শুভ নিজের জীবনের সব কষ্টকে এক জায়গায় জড়ো করে। আজ সে কষ্টের বিস্ফোরন ঘটাবে। পরিস্কার আকাশে ভরাট চাঁদ। নীল নয়, সাদা নয়- এমন আকাশের রঙ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের রেলের পাতের উপর শুভ শুয়ে আছে। জ্বরে ও ক্লান্তিতে তার চোখে ঘুম নেমে আসে। সে স্বপ্নে দেখে: তার উপর দিয়ে ট্রেন চলে গেছে। তার শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, রক্তাক্ত। তার শরীরের ফোটা ফোটা রক্ত পদ্মার বুকে পড়ছে। সেই রক্তের ছোঁয়ায় পদ্মা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। পাতাল ফুড়ে বেরিয়ে এসেছে পানির ধারা। পদ্মা ক্রমে ক্রমে তার আপন রূপ ফিরে পাচ্ছে। পদ্মা ফুঁসে উঠছে। পদ্মার ঢেউ আছাড় খাচ্ছে কিনারে। উথাল পাথাল ঢেউয়ের সাথে নাচছে রূপালি ইলিশ। মাছ ধরার ছোট্ট ডিংগি থেকে কোন ‘কুবের’ হাঁক ছাড়ছেঃ “ও মাঝি, নৌকা কোন গাঁয়ের?” শুভ বিরবির করে নিজের এপিটাফ উচ্চারণ করলোঃ “আমি পথিক, অবশেষে পথ খুঁজিয়া পাইয়াছি।”
এর কিছুক্ষণ পরেই ঘুমন্ত শুভ’র উপর দিয়ে একটা ট্রেন লম্বা হর্ণ বাজিয়ে ছুটে গেলো।

Scroll to Top