সাহিত্য বা চিন্তার চর্চা; প্রচলিত, মসৃন, চকচকে এবং গতানুগতিক প্রবাহের বাইরে যে এবরো খেবরো ধারা, অন্তর্চক্ষু বা তৃতীয় নয়ন সমভিব্যাহারে যা খুঁজে বের করতে হয়, লিটল ম্যাগাজিন সংশ্লিষ্টদের মতে তা-ই লিটল ম্যাগাজিন। তবে এই কথাটুকুই যে লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞার জন্য যথেষ্ট তা বলা যুক্তিযুক্ত হবে না। এখানে লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা আমার উদ্দেশ্যও নয়। লিটল ম্যাগাজিনকে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনও বলা হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন শব্দটির সাথে সার্বিক অর্থে সংহতি ও স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। আমি আমার পাঠ, পর্যবেক্ষণ ও অনুভব দিয়ে মনে করি লিটল ম্যাগাজিন শুধুমাত্র কিছু ছাপা পৃষ্টার বাঁধাই করা সংকলন মাত্র নয়। লিটল ম্যাগাজিনের দার্শনিক পটভুমি, সংগঠন, কট্টর বা উদার পন্থা, রাজনৈতিক ডিসকোর্স, সমাজ বিশ্লেষণ, লেখার ফর্ম ইত্যাদি অনেককিছু নিয়ে যে যজ্ঞকাণ্ড করে সেটা যে কোনও মিডিয়া হাউসের দৈনিক, সাপ্তাহিক, ত্রৈমাসিক বাণিজ্যিক প্রকাশনার চেয়ে অনেক বেশি কিছু, অনেক গভীর কিছু। অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই শুধুমাত্র বোধ এবং বোঝাপড়ার (শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচি, হৃদয়বৃত্তি) দায়বদ্ধতা থেকেই মূলত একেকটি লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্র তৈরি হয়। এ জন্যই যত ক্ষুদ্র পরিসরেই এর পাঠ পরিধি বা অংশগ্রহন থাকুক না কেন, প্রত্যেকটি লিটল ম্যাগাজিন স্বতন্ত্রভাবে একেকটি আন্দোলন। যে আন্দোলন কোনও না কোনও ভাবে তার পরিপার্শ্বে নতুন করে ভাবতে পারার, চিন্তা করতে পারার আগ্রহ ছড়িয়ে দিতে পারে।
লিটল ম্যাগাজিনের অনেকগুলো বৈশিষ্টের মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান এবং আলোচিত বৈশিষ্ট হলো প্রতিষ্টান বিরোধিতা। লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিষ্টান বিরোধীতার কথা শুনলেই সাধারণত প্রতিষ্টান হিসাবে বাণিজ্যিক দৈনিক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক সাময়িকির কথাই আমাদের মনে আসে। প্রতিষ্টান বিরোধিতা প্রসঙ্গে কয়েকজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ও লেখকদের কিছু বক্তব্যের উদ্ধৃতি সংযুক্ত করতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু সেটি সম্ভব হচ্ছে না বলে একটু মন খারাপও লাগছে। কারণ প্রায় সাতাশ বছর ধরে সংগ্রহ করা লিটল ম্যাগাজিনগুলো বিসর্জন দিয়ে আমাকে বর্তমানকে যাপন করতে হচ্ছে। প্রতিষ্টান বিরোধীতার ব্যাপারে লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজ চর্চাকারীদের মধ্যেও একটা সাধারণ প্রবণতা লক্ষণীয় যে, দৈনিকে লেখা ছাপতে না পাঠানোকেই প্রতীষ্টান বিরোধীতার সবকিছু ভাবতে পছন্দ করা। এটা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, দৈনিকে লেখা না পাঠানোর মধ্য দিয়ে একটা প্রাতিষ্টানিক সিস্টেমকেই অস্বীকার করা হয় এবং বিরোধিতা করা হয়।
আমাদের দেশে তিরিশের দশক থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অন্যান্য হৃদয়বৃত্তিয় আনুষ্টানিকতা বিকাশের সাথে সাথে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনেরও বিস্তৃতি ঘটে। তখন থেকেই সাহিত্য রুচি নির্মাণ এবং সাহিত্য তত্ত্ব, রাজনৈতিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনায় লিটল ম্যাগাজিন একাডেমিয়ার পাশাপাশি একটা পরিপূরক ও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু এও সত্য যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধঃপতন, গৃধ্নু রাজনৈতিক সামন্তবাদের উত্থান, তৃণমূল পর্যায়ে ধর্মীয় মৌলবাদের বিস্তৃতি এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজনের বিস্তারের বিপরীতে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে এখন পর্যন্ত কিছু প্রতীকি প্রতিবাদ ছাড়া তেমনভাবে সমালোচনা, খন্ডন ও বিরোধীতার জায়গায় দেখা যায়নি। অবশ্য লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদেরও জীবিকা নির্বাহের সংগ্রামে অংশ নিতে হয়, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দূবৃত্তায়নের অংশ প্রতীষ্টানগুলোতে (রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রিয় আমলাতন্ত্রের যোগসাজশজাত সিস্টেমের বাইরে কারো থাকার উপায় নাই।) শ্রমদাসত্ব করতে হয়। যারা স্বাধীনভাবে কিছু করার চেষ্টা করেন তাদেরকেও টিকে থাকার প্রয়োজনে নির্ভর করতে হয় দলীয় রাজনীতির সূতায় বাঁধা সিস্টেমের অনুগ্রহের। তো এই বৃত্তের মধ্যে থেকে বৃত্তজাত কার্যক্রম নিয়ে কিছু লেখা মুসকিলের বটে। যেখানে বৃত্ত নিজেই তার এবং তার প্রয়োজনে ব্যবহার্য সবকিছুকে সমালোচনার উর্ধে বলে কানুন সাটিয়ে দেয়। এই একচ্ছত্রবাদ, উদ্ধত এককেন্দ্রিকতা, “তেড়ে মেরে ডান্ডা করে দিব ঠান্ডা” স্টাইলের রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ের ধর্মীয় উগ্রবাদ; ক্রমাগত মানুষকে, মানুষের চিন্তা-বোধ ও বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পারষ্পর্য থেকে মানুষদেরকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। এটা নিশ্চিতভাবেই একটা সংহারক অবস্থা। এই অবস্থা মানবতাবাদকে সংহার করে, মানবিক বোধ শক্তিকে বিনষ্ট করে, মানুষের সাথে মানুষের যে আস্থা ও দায়বদ্ধতার সম্পর্ক সে জায়গাটাকে দূর্বল করে দেয়।
এই রকম দমবন্ধ, হতাশ, অবিন্যস্থ পরিবেশে লিটল ম্যাগাজিনের শুধুমাত্র সাহিত্য চর্চার সৌখিনতার ঘেরাটপে আটকে রাখাটা লিটল ম্যাগাজিনের চেতনা এবং স্পিরিটের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ নয়। মানুষের জীবন একটা প্রবাহমান স্রোত। জীবনকে কেন্দ্র করেই পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের কাঠামো আবর্তিত হয়। এই আবর্তনে প্রাগ্রসরতা হালনাগাদকরণের একটা বড় ধরণের দায়িত্ব পালন করে থাকেন লেখক এবং চিন্তক। লেখককে তাই দাঁড়াতে হয় স্থবিরতা এবং প্রচলিত প্রথা ও কাঠামোর বিরুদ্ধে। দুঃসময়ের, দুঃশাসনের, শোষণ, নিগ্রহ ও সিস্টেমের ব্যবচ্ছেদ করার দায়িত্ব রয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের। কারণ শিল্প ও জীবন, এ দুয়ের সমন্বিত জীবন-দৃষ্টি ও অবলোকনের লড়াইটুকুই হলো লিটল ম্যাগাজিন।