গন্ধম: লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন কেন? এর সমস্যা ও সম্ভাবনার দিকগুলো কী হতে পারে?
আহমেদুর চৌধুরী: স্বতঃস্ফূর্ত অভিজ্ঞান থেকে, এক ধরনের অনুভূতির দায়বদ্ধতা থেকেই লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা। অন্তর্গত বোধ কিংবা চৈতন্য- যার দহন, যন্ত্রণা, অভিঘাতই লিটল ম্যাগাজিনের পথে আমার গুরু বা মুর্শিদ। যে কোনো লিটল ম্যাগাজিনই পথ চলে অপরিচিত পাষাণ পাথর কেটে কেটে, ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত হয়ে। আমার অর্থাৎ ‘শুদ্ধস্বরে’ এর ব্যত্যয় হয় নাই। লিটল ম্যাগাজিনের পুরোটাই সম্ভাবনা। তত্ত্ব, স্টাইল, নিরীক্ষা আর মত প্রকাশের অসীম সম্ভাবনার ক্ষেত্র, লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া আর কোথায় আছে? সমস্যা যা যা আছে তার সবই হলো পারিপার্শ্বিক। আমি মনে করি পারিপার্শ্বিক সমস্যার মুখোমুখি না হতে পারলে একটা লিটল ম্যাগাজিনকে কখনোই পরিপূর্ণ করে তোলা যায় না।
গন্ধম: একটা সময় লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আন্দোলন একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল— এখন তা পর্যবসিত হয়েছে পাওয়া ও পাইয়ে দেওয়ার ধান্দাবাজি এবং বামন সাজার পৈতা হিসেবে। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার চটকদার কথা বলতে বলতে বিজ্ঞাপননির্ভর কাগজ নিজেই প্রতিষ্ঠানে পরিণত, এই অভিযোগের আলোকে আপনার মতামত?
আহমেদুর চৌধুরী: লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা কখনোই শেষ হবার নয়। আর সচেতন অসচেতন ধান্দাবাজিতো মানব ইতিহাসেরই অংশ বিশেষ। তবে কমিটমেন্টের সততা ছাড়া লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে কেউ যেমন অংশ নিতে পারে না, তেমনি টিকেও থাকতে পারে না। লিটল ম্যাগাজিনকে পৈতা বানিয়ে যারা ব্রাহ্মণ সেজে দাদাগিরি করে তাদের বামনরূপ প্রকৃতির আপন নিয়মেই উন্মোচিত হয়ে যায়। ধান্দাবাজরা শেষ পর্যন্ত ধান্দাবাজির বৃত্তের বাইরে খুব একটা আসতে পারে না।
প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন কখনোই বিজ্ঞাপন নির্ভর নয়। কিন্তু বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা তো অস্বীকার করা যাবে না। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি চাকরি কিংবা ব্যবসার মাধ্যমে অঢেল অর্থ উপার্জন করে অনেক কিছুই এমনকি সাহিত্য/ বিনোদন পত্রিকা পর্যন্ত বের করা সম্ভব কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন বের করা কখনো সম্ভব নয়। এমনটি আজ পর্যন্ত দেখাও যায়নি, অন্তত আমি দেখিনি। তো বিজ্ঞাপন না নিলে লিটল ম্যাগাজিন বেরুবে কী করে? সখের ক্যামেরা-ঘড়ি তো আর অসংখ্য থাকে না যে, প্রত্যেক সংখ্যার জন্যই বিক্রি করে করে প্রেসের দায় শোধ করা যাবে।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তো প্রেক্ষাপট ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একেক সময় একেক রকম হয়। এই ক্ষেত্রে সার্বিক অর্থেই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে এর অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার মনে হয়।
পশ্চিমবঙ্গ যদি কোনোদিন স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আবির্ভূত হয়, তাহলে সেখানেও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। তবে আমাদের মূল সমস্যা আমার মতে নষ্ট রাজনীতি আর বল্গাহীন বাজার অর্থনীতি। জাতি হিসাবে আমরা কেমন যেন এঁকেবেঁকে পথ চলছি, কেমন যেন লাফিয়ে চলার Flexibility আমাদেরকে গ্রাস করেছে। এইসব কারণে পশ্চিমবঙ্গের মতো আমাদের দেশে তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তেমনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী উল্লেখ করার মতো কোনো আন্দোলনও গড়ে উঠেনি, তো এইসব এক ধরনের সরল চাতুর্যতা আর Flexible বৈশিষ্ট্যের কারণে চিন্তা ও নিরীক্ষায় আমাদের দৈন্যতাই বেড়েছে। একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে, লিটলআকারে ছাপা যেকোনো সংকলনই লিটল ম্যাগাজিন নয়। প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনে কখনোই চটকদার কথা বলার প্রবণতা লক্ষ করা যায় না। (এখানে পাঠককে অবশ্যই সিরিয়াস, গভীর ও চটকদার কথার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে।) তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষোভ ও আবেগের অনিয়ন্ত্রিত প্রকাশ ভাষাকেও আক্রান্ত করে- এটা অস্বীকার করা যাবে না।
গন্ধম: লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীবদ্ধ সংকীর্ণতার উর্ধ্বে যেতে পারে না- আত্মচর্চার ঘেরাটোপে আটকে পড়ে? ঠেক কিংবা হার্স্টের শরীর কোনো বিশেষ লেখকগোষ্ঠী তৈরি করতে কি সক্ষম হয়েছে?
লিটল ম্যাগাজিন তো গোষ্ঠিবদ্ধ চর্চারই ক্ষেত্র। কখনো ছোট গোষ্ঠি, কখনো বা বড় গোষ্ঠি। এভাবেই কেউ কেউ লেখক হয়েছেন এবং হচ্ছেন। কখনো কখনো দেখা যায় এক ধরনের ব্রাহ্মণ্য ঘেরাটোপ তৈরি হয়ে যেতে। এ ধরনের ঘেরাটোপ থেকেও ভাল লেখক বের হতে পারে না।
গন্ধম: লিটলম্যাগ এবং বাণিজ্য পত্রিকা দ্বন্দ্ব দীর্ঘ শত্রু এবং সূত্রতার— এটা কি একে অপরকে অতিক্রম করতে না পারার কৌশল?
আহমেদুর চৌধুরী: লিটল ম্যাগাজিন আর বাণিজ্য পত্রিকার চরিত্রই তো দুই রকম। অতএব এখানে শত্রুতা, সূত্রতা কিংবা পারস্পরিক অতিক্রম করার প্রসঙ্গ ওঠানোই তো অবান্তর।
গন্ধম: সাহিত্যনির্ভর অজস্র লিটল ম্যাগাজিন নতুনদের আত্মপ্রকাশ বিকাশ প্রতিষ্ঠার নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। ইদানিং সাহিত্যমূর্খ বামনরা এর পাতায় পাতায় বসে আছেন— মন্তব্য করুন।
আহমেদুর চৌধুরী: শুধু কবিতা না, আমি মনে করি নতুনদের প্রকাশ বিকাশ এবং প্রতিষ্ঠার নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল কিংবা উপযুক্ত ক্ষেত্র হলো লিটল ম্যাগাজিন। আর বিষয় হিসাবে সুনির্দিষ্টভাবে অর্থনীতি, রাজনীতি, বিস্তৃত ও বিস্তারিতভাবে আলোচিত হতে পারে/হওয়া উচিত যেকোনো ফর্মে এই লিটল ম্যাগেই। এমনকি কৃষি-স্বাস্থ্যও বাদ দেয়া উচিত নয়। আমি তো আগেই বলেছি, লিটল আকারের সংকলন মাত্রই লিটল ম্যাগাজিন হতে পারে না।
গন্ধম: দুই বাংলার লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?
আহমেদুর চৌধুরী: কমিটমেন্ট আর চরিত্র ধরে রাখার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের লিটল ম্যাগাজিনগুলো বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে, অনেক বেশি দৃঢ়। সেই অর্থে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে গড়ে ওঠেনি। তবে বেশ কিছু সম্ভাবনাময় উদ্যোগ চোখের সামনে ভেঙ্গে যেতে দেখেছি। এক্ষেত্রে জাতিগতভাবে নেতৃত্বশূন্যতার মতোই লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনেরও দূরাবস্থা চলেছে। আমরা এখনো আইডল বলতে তো কিছু পাইনি। এসবের জন্য আমি ভোগবাদিতার ঘোড়ায় চেপে বাজার অর্থনীতির উল্লস্ফনকেই দায়ী মনে করি। এতসব কিছুর পরও শেষ পর্যন্ত আমি কিন্তু আশাবাদী।
গন্ধম ৩
সম্পাদক: মালেকুল হক
প্রকাশকাল: ২০০৫-২০০৬