আঠারো শতকের শেষ থেকে আমেরিকা ও ইউরোপে প্রতীষ্টান বিরোধী ও সাহিত্য-শিল্পে বিদ্রোহ, অস্বীকার ও প্রথা ভাঙার আকাঙ্খা সম্বলিত লেখা ও আঁকা প্রকাশের যে মাধ্যমটি গড়ে উঠেছে, আমরা লিটল ম্যাগাজিনের আদি ইতিহাস বলতে একেই জানি। মূলত লেখা এবং লেখাকে অবলম্বন করেই আবর্তন শুরু করেছিলো এই তৎপরতা বা আন্দোলন।
নিঃসন্দেহে যে কোনো ধরনের বিদ্রোহ, অস্বীকার, প্রথা ভাঙা বা বদলানোর প্রচেষ্টা, সেটা লেখা হোক বা মিছিল: এর মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা, অভিলাষ ও ত্বত্ত্ব কাজ করে। রাজনীতি অনেক সময় সরাসরি এবং বেশিরভাগ সময় বোধ হিসাবে ক্রিয়াশীল থাকে। সাধারণভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অগ্রসর চিন্তা, জানার কৌতুহল, পুরাতনকে ভেঙে নতুন কিছু করার আকাঙ্খার মধ্য দিয়েই লিটল ম্যাগাজিন ধারনাটি গড়ে উঠেছে। এবং এজন্যই বলা হয়ে থাকে “লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন”। এই আন্দোলনের মূল মাধ্যম লেখালেখি। আমরা দেখি লেখালেখির, মানে কবিতা বা ছোট গল্প বা পর্যালোচনা/ বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ বা সমালোচনার ধরন, গঠন ও প্রকরণ নিয়েও লিটল ম্যাগাজিনের আছে ব্যাপক পরীক্ষানিরীক্ষা, তর্ক-বিতর্ক। যে নিরীক্ষা কোনও প্রতিষ্টান পরিচালিত মাধ্যমে অর্থাৎ পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
বাংলা অঞ্চলেও লিটল ম্যাগাজিনের বৈচিত্রপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক সূত্রে প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রের হাত ধরে এই অঞ্চলে লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হলেও আক্ষরিক অর্থে বুদ্ধদেব বসুর প্রগতি ও কবিতা পত্রিকার হাত ধরে ইউরোপ ও বহির্বিশ্বের অন্যান্য শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন ফর্ম ও ধারার মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে কলকাতা ও ঢাকা কেন্দ্রীক লিটল ম্যাগাজিন ধারনার বিকাশ ঘটে । বাংলা কবিতা, গল্প এবং সাহিত্যের অন্যান্য ধারার আধুনিক রিফরমেশন ও ঢং-ঢাং-সজ্জ্বার প্রধান পরিবর্তনও ঘটে লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করেই। বহির্বিশ্বের সাহিত্যের সাথে বাংলা সাহিত্যের যে উজ্জ্বল, জীবনবাদি, ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনোদর্শনগত সংঘাত ও সংযোগ এবং রাজনৈতিক বাস্তবতাবোধের সংশ্লেষ, তাও ঘটে লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করেই। এই মনন, জীবন বোধ ও মানসিকতা বাঙালীর মধ্যবিত্ত শ্রেণীচেতনার কিঞ্চিত অংশ বটে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে সাতচল্লিশ উত্তর পূর্ববঙে সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রীক যে অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ, উদার, ন্যয্যতা, অর্থনৈতিক এবং লৈঙ্গিক সমতা ভিত্তিক যে রাজনৈতিক চেতনার উত্থান এবং অগ্রসর চিন্তার বিস্তার লক্ষ্য করা গিয়েছিলো; একাত্তরের স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যাপক চর্চা এবং উদ্যেগ পরীলক্ষিত হলেও, হতাশ হওয়ার মতো সত্য যে, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এর কোনো বৃহত্তর প্রভাব চোখে পড়েনি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন, সাহিত্য চর্চা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম; এসবের মাধ্যমে কিছু স্বতন্ত্র বৈক্তিক স্বর লক্ষ্য করা গেলেও গণতন্ত্র-বাক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের উপর আঘাত এবং ধমীর্য় উন্মত্ততা বা রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক গোষ্টির যৌথ সাম্প্রদায়িক/ সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিছু একক লেখৈালেখি ছাড়া সামগ্রিকভাবে, লক্ষ্যনীয়ভাবে তেমন কোনো প্রতিবাদ চোখে পড়েনি। হতে পারে এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৈন্যতারই বহিপ্রকাশ।
সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠে লিটল ম্যাগাজিনের বা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সক্ষমতার জায়গাগুলো কোথায়? সাথে সাথে অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে অর্জিত একটা স্বাধীন দেশে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের ব্যর্থতার জায়গাগুলোই বা কোথায়? শুধু কিছু নিভৃত ব্যক্তি অভিরুচি তৈরি করাই কি লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সার্থকতার জায়গা? নাকি এর সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাও রয়েছে? যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা কোথায় এবং কতটুকু? অবাধ-উন্মুক্ত তথ্যপ্রযুক্তি ও অনলাইনের যুগে শুধু মাত্র নতুন লেখকের লেখা প্রকাশের সুযোগ তৈরি করে দেয়ার দাবি করা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যুক্তিসংগত বলে প্রতীয়মান হয় না।
লিটল ম্যাগাজিন মানেই হবে সেই প্ল্যাটফর্ম, যা জগতের সকল সৃজনশীলতাকে নিয়ে নিরীক্ষার পাশাপাশি প্রবল ও দ্বিধাহীনভাবে বাক স্বাধীনতার পক্ষে থাকবে, প্রতিনিধিত্ব করতে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মুল্যবোধের।